পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ ঘুষ আদায়ের অভিনব কোচিং ক্লাস

হাওর বার্তা ডেস্কঃ পুলিশ সদস্য নিয়োগে ঘুষ ও দুর্নীতি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় থাকলেও থেমে নেই দালাল ও প্রতারকদের দৌরাত্ব। বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী দায়িত্ব গ্রহণের কিছু দিন পরই সারাদেশ থেকে ১০ হাজার পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। অপরদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন উপপুলিশ কমিশনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিকে বদলিসহ বিভিন্ন নামে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ তোলেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সারাদেশে এই ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে প্রত্যেক জেলায় এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পদমর্যাদার দুজন করে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই পর্যবেক্ষক টিমের সদস্যদের নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বৈঠক করেন আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তারা জেলায় গিয়ে পর্যবেক্ষকরা কীভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি ও তদবির সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করবেন সে বিষয়ে সার্বিক দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন আইজিপি।

সূত্র জানায়, সেই পর্যবেক্ষকদের নিয়োগ নিয়ে তারা যখনই কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির গন্ধ পাবেন তখনই যেন পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়। পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়। অপরদিকে বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারে পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করছে এবার পুলিশ নিয়োগে কোনো প্রকার ঘুষ চলবে না। আর এই বক্তব্যকে বিভিন্ন এলাকার সরকার দলীয় সংসদ সদস্যগণ সমর্থন দিয়ে আসছে। তারপরও পুলিশ নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের ঘটনা থামছেই না।

নারায়ণগঞ্জে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য ২০ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলায় পুলিশেরই একজন এএসআইকে গ্রেপ্তরও করা হয়েছে। তার নাম শাহাবুদ্দিন। দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার সেই পুলিশ কর্মকর্তা এএসআই শাহাবুদ্দিনকে গ্রেপ্তারের পর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি পুলিশি প্রহরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর আগে তিনি গ্রেপ্তারের পর তার বুকের বাম পাশ ব্যথা শুরু হয় এবং বমি করতে থাকেন। পরে তাকে পরে প্রথমে তাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরস্থ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার রাতে বিষয়টি পুলিশের একটি সুত্রে জানা যায়।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বাইতুল্লাহ মসজিদের পূর্বপাশে গালাক্সি স্কুলের ভেতরে প্রত্যাশা নামে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের কথা বলে একটি কোচিং সেন্টার খোলেন পুলিশের ঢাকার বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহাবুদ্দিন। এরপর শাহাবুদ্দিন ও বাদশা নামের দুইজনে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে সিয়াম, স্বদেশ, মোস্তাকিম, তৌহিদ, রায়হান, রুবেল ও মারুফা আক্তার মলিসহ ২০ জনের কাছ ৪ লাখ টাকা করে মোট ৮০ লাখ টাকা আদায় করেন। এরপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ফতুল্লাহ পুলিশ লাইনসের মাঠে প্রথম ধাপে শারীরিক ফিটনেসের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

আর শারীরিক পরীক্ষায় অর্থ প্রদানকারী যুবকদের অনেকেই বাদ পড়লে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ফাঁস করা হয়। পরে এ ঘটনায় ১৪ জনকে আটক করে। তারা ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের জানান, যে এএসআই শাহাবুদ্দিন ও বাদশা তাদেরকে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের কথা বলে প্রথমে কোচিংয়ে ভর্তি করায়। এরপর পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে জনপ্রতি ৪ লাখ টাকা করে নেয়। তবে প্রথম ধাপে অর্থাৎ শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষায় অনেকেই বাদ পড়ে যান। আর এতেই তাদের প্রতারণার বিষয়টি এলাকায় ফাঁস হয়।’ পরে ওইদিনই ঘুষ প্রদানকারী স্বদেশ ভুইয়া বাদী হয়ে বন্দর থানায় দুইজনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন।

মামলা আসামি করা হয়, ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের নিশং এলাকার শাহাবুদ্দিন ও একই এলাকার মোশারফের পুত্র বাদশা। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহাবুদ্দিনকে ফতুল্লার শিবুমার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ রাশেদ মোবারক।

নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, গ্রেপ্তারকৃত পুলিশ সদস্য আমাদের হেফাজতেই আছে। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ঘুষের বিনিময়ে পুলিশে চাকরি কথা বলে টাকা নেওয়ার অপরাধে ফুরকান নাহার (৪২) নামক এক নারী প্রতারককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের দেলী গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার চরবাহাদুর গ্রামে। প্রতারক ফুরকান নাহার ওই গ্রামের মফিজ উদ্দিনের মেয়ে এবং একই গ্রামের রুহুল আমিনের স্ত্রী। তার বিরুদ্ধে প্রতারিত মোঃ জহিরুল ইসলাম খান বাদী হয়ে কসবা থানায় মামলা দায়ের করেন। আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, প্রতারক নারী ফুরকান নাহার বাদীর চাচাত ভাই মোঃ জমসিদ খানের পূর্ব পরিচিত। জমসিদের মাধ্যমে পরিচয় হয় এই প্রতারক নারীর সঙ্গে। তার অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় আছে। তাকে ৫ লাখ টাকা দিলে পুলিশে চাকরি দেওয়ার নিশ্চিয়তা দেন। চাচাত ভাই জমসিদ এবং প্রতারক নারীর কথায় বিশ্বাস করে তার ছেলেকে পুলিশে চাকরি দেওয়ার জন্য কয়েক মাস পূর্বে নারীকে ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেয় জহিরুল ইসলাম।

আর বাকি টাকা চাকরি হওয়ার পর দেওয়া হবে। কিন্তু গত ২৫ ফ্রেরুয়ারি চাকরি না দিয়েই বাকি টাকা নিতে আসে। জমসিদ ও নারী জানান, চলতি বছরের আগামী ৬ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশে লোক নেবে সেখানে তার ছেলেকে চাকরি দেবে। তার কথায় জহিরুল ইসলামের সন্দেহ হলে সে ঘটনাটি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহাম্মদ খানকে জানান। পরে চেয়ারম্যান কসবা থানার ওসিকে খবর দিলে পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে। আমার সংবাদের মাদারিপুর জেলা প্রতিনিধি জানান, পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা গেছে। জেলা পুলিশের আর আর কে ক্লোজড করা হয়েছে।

আর রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়েছে। এলাকায় দায়িত্বরত একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজৈর থানার ওসি পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগে ঘুষ লেনদেন ও তদবিরের কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে বলে শোনা গেছে। সূত্র জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে দুইটি ধাপে দেশের ৬৪ জেলায় প্রায় ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। জেলা পুলিশ সুপারের অফিস থেকেই এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গত বছরের শেষের দিকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়। ওই সার্কুলারের পর থেকেই এক শ্রেণির পুলিশ এবং রাজনীতিবিদ মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়। তাদের এজেন্টের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ ওঠে।

এরমধ্যে কোনো কোনো জেলায় ১০ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম উঠে। আর ওই এজেন্টদের সুপারিশের ভিত্তিতে কতিপয় মন্ত্রী-এমপি ডিও লেটারও তৈরি করেছিলেন। পরে তৎকালীন আইজিপি ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করেন। পরে গত ৩১ জানুয়ারি জাবেদ পাটোয়ারী আইজিপি হিসেবে যোগদানের পর ঝুলে থাকা নিয়োগ প্রক্রিয়া ফের চালু করেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাহিনীতে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোনো চাকরি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের প্রমাণ পেলে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কোয়ার্টার্লি কনফারেন্সে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি এই নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘আসন্ন কনস্টেবল নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। যাতে এ নিয়োগ নিয়ে কোনো ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত না হয়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা সুষ্ঠুভাবে কনস্টেবল নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারবো।’ উল্লেখ্য, গত ২১ ডিসেম্বর ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে ৮ হাজার ৫০০ জন পুরুষ এবং এক হাজার ৫০০ নারী সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল।

পরে ‘অনিবার্য কারণবসত’ ১৪ জানুয়ারি এই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি আবারও নতুন করে ১০ কনস্টেবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) সহেলী ফেরদৌস আমার সংবাদকে বলেন, পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ সর্ব্বচো সতর্কতার সহিত নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। আমরা চেষ্টা করছি শতভাগ স্বচ্ছতার সহিত নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে। তারপরও কোথাও কোনো বিচ্ছন্ন ঘটনা ঘটে। সেটাও আইনগতভাবে দেখা হবে বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর